স্টাফ রিপোর্টার : জনরোষে শেখ হাসিনা সরকার পতন পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুলিশ শুন্য নগরীতে ফের রাস্তায় নেমেছেন হকাররা। সিসিক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর আত্মগোপন ও সিসিক কর্মকর্তাদের অনুপস্থিতিতে কর্পোরেশনে দেখা দেয় অচলাবস্থা। ফলে সংকুচিত হয়ে গেছে ফুটপাত ও রাস্তা, বেড়েছে যানজট। একই সাথে যত্রতত্র বেড়েছে সিএনজি অটোরিক্সা পার্কিং। এমন অবস্থায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে দায়িত্ব পালনকারী আনসারী ও শিক্ষার্থীরা পড়েছেন বেকায়দায়।
পুলিশের অনুপস্থিতি ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের নিরবতার সুযোগে নগরীর ফুটপাত ও রাস্তা দখলের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন হকাররা। সিসিকের পক্ষ থেকে একশনে যাওয়ার কথা থাকলেও সোমবার পর্যন্ত কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠছেন হকাররা। রাস্তার পাশাপাশি নগরীর লালদিঘীর পাড়ে নির্মিত অস্থায়ী হকার মার্কেটও দখলে রেখেছেন তারা।
সোমবার সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর তালতলা পয়েন্ট থেকে শুরু করে নগরীর বন্দরবাজার পয়েন্টের রাস্তায় দুদিকে রিক্সাভ্যান ও ঠেলাভ্যান নিয়ে হকাররা দেদারছে বসে আছেন। বন্দরবাজার থেকে রংমহল টাওয়ারের রাস্তার পাশও চলে গেছে হকারদের দখলে। মধুবন মার্কেটের সামন থেকে জেলরোড, কোর্ট পয়েন্ট থেকে চৌহাট্টা পর্যন্ত সর্বত্রই হকারদের দৌরাত্ম বেড়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় নগরীর লালদিঘীরপারস্থ হকার মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, সেখানেও রয়েছে হকারদের অবস্থান। তবে অর্ধেকের বেশী দোকান খালি পড়ে রয়েছে। আবার কেউ কেউ লালদিঘীরপারেও ব্যবসা করছেন আবার রাস্তায়ও ব্যবসা করছেন।
জানা গেছে, ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। এতে নগরভবনের কার্যক্রমে নেমে আসে স্থবিরতা। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা অভিভাবকহীন শহরে হকাররা তাদের নির্ধারিত স্থান ছেড়ে ফের রাস্তায় বসে পড়েছেন। এতে তৈরী হচ্ছে রাস্তায় দীর্ঘ যানজট। ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।
এরআগে চলতি বছরের ১০ মার্চ হকারদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে লালদিঘীপাড় এলাকায় হকারদের অস্থায়ী মার্কেট। প্রতিদিন দুপুর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলতে থাকে ব্যবসা। প্রায় কোটি টাকা ব্যয়ে সাড়ে চার একর মাঠে মাটি ভরাট, ইটের সলিং, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা করে দেয় সিলেট সিটি করর্পোরেশন।
নগরীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে, ফুটপাতের পাশাপাশি মূল সড়কের অর্ধেকেরও বেশি দখল করে পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসছেন হকারেরা। এতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ফুটপাত ছেড়ে রাস্তার উপর দিয়ে হাটতে হচ্ছে তাদের। হকারদের কারণে নগরে যানজটও বেড়েছে।
ছাত্র—জনতার আন্দোলনের পর গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সারাদেশের মতো রাস্তায় নেমে আসে সিলেটের সাধারণ মানুষও। হামলা হয় মেয়র আনোয়ারুজ্জামনের পাঠানটুলা বাসায়। তখন থেকেই আড়ালে চলে যান যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন। তবে সিসিক সূত্র জানিয়েছে, মেয়র দেশেই রয়েছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিয়মিত অফিস করবেন। সোমবার নগরীর চৌহাট্টা, জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, তালতলা, সুরমা মার্কেট পয়েন্ট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আম্বরখানা, মদিনা মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি এলাকার ফুটপাত হকারদের দখলে। সিলেট জেলা পরিষদের সামনে হকারদের বসে থাকতে দেখা যায়। জেলা পরিষদের সামনে দিনের বেলা ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করেন হকারেরা। আর বিকেলের পর রাস্তার অর্ধেক দখল করে সবজি, মাছ ও ফল বিক্রি করা হয়।
এদিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে ফলমূল বিক্রি করতে দেখা যায় হকারদের। খোদ নগর ভবনের ফটকের সামনেও রয়েছে হকারদের দৌরাত্ম্য। সেখানে বসে ঘড়ি, চশমা, চাবি, সবজির দোকান। নগরের বন্দরবাজার—জিন্দাবাজার এই সড়কের দুই পাশের ফুটপাত পুরোটাই হকারদের দখলে।
অনেকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাবিহীন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মেয়র আনোয়ারুজ্জামান সিলেটকে ক্লিন ও স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে হকার পুনর্বাসনের ঘোষনা দেন। এ নিয়ে সিলেটের ব্যবসায়ীসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে লালদিঘীপাড় মাঠকে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলে সেখানেই সিলেট নগরের হকারদের পুনর্বাসন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ জন্য তিনি হকারদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। হকাররাও মেয়রকে সড়কে না বসে মাঠে ব্যবসা করার কথা দেন।
২০২১ সালে হকার পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ওই বছরের জানুয়ারিতে নগরভবন—লাগোয়া লালদিঘীর পাড়ের খোলা মাঠে হকারদের জন্য অস্থায়ীভাবে পুনবার্সনের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বেশি দিন সেখানে থাকে নি। তার কারণ ছিল তাদের লাইটিং সমস্যা, রাস্তার সমস্যা ছিল প্রধান করাণ। প্রাথমিক অবস্থায় ২০২১ সালে নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১ হাজার ৭০ জন হকারকে পুনর্বাসন করা হয়। তবে দুই বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভেস্তে যায় হকার পুনর্বাসনের সে উদ্যোগ।
শেষ সময়ে এসে চলমান পরিস্থিতিতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সিসিকের হকার পুনর্বাসন কার্যক্রম। নগরীর বন্দরবাজার এলাকায় এসপি অফিসের সামনে কথা হয় পথচারী আনোয়ার হোসেনের সাথে। তিনি বলেন, রাস্তায় পুলিশ নেই। আমাদের সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা বৃষ্টিতে ভিজে ট্রাফিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এরই মধ্যে হকাররা যদি রাস্তা দখল করে বসে এটা ত মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ এর মতো। সিটি কর্পোরেশনের উচিত দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
লালদিঘীরপারের হকার আরিফ হোসেন বলেন, আমি এখানেই ব্যবসা করছি। কিন্তু হকারদের একটা বিশাল অংশ রাস্তায় চলে গেছে। এতে এখানে ক্রেতার উপস্থিতি কমেছে। আমরা যারা এখানে আছি তারা লোকসানে পড়েছি।
সোমবার রাতে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আহমদ চৌধুরী দৈনিক জালালাবাদকে বলেন, সারাদেশের ন্যায় বর্তমানের সার্বিক পরিস্থিতি তেমন ভালোনা। এই সুযোগে হকাররা রাস্তায় নেমে এসেছে। আমরা সিসিকের কার্যক্রম স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। শীঘ্রই একশনে নামবো। এক্ষেত্রে সাংবাদিকসহ নগরবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে সার্বিক পরিস্থিতিতে একটু সমস্যা হতে পারে তবে সেগুলো দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সকল কর্মকর্তা—কর্মচারী নিয়মিত অফিস করছেন। শীঘ্রই আমাদের মোবাইল কোর্ট নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করবেন। তখন থেকে হকাররা আর সড়কে বসতে পারবেন না। তারা তাদের জয়গায় যেতে হবে।