হাওরাঞ্চল ডেস্ক:
যার নুন আনতে পান্তা পুরাত সেই আজ কোটি টাকার মালিক। তৈরী করেছেন বিশাল আলিশান ভবন। ভাড়ায় মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করে পরিবার চালাতেন মানিক মিয়া। তার জীবনে ছিল না কোনো চাকচিক্য। তবে একটা সময় মাটরসাইকেলে যাত্রী বহনের আড়ালেই শুরু করেন মাদক ও চোরাই পণ্যের বেচা—কেনা। আর তাতেই গত ২ থেকে ৩ বছরের মধ্যে আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান। ছেড়ে দেন মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন। জমি কিনে গড়ে তুলেছেন বিশাল আলিশান নতুন বাড়ি। তার নেতৃত্বে এলাকায় গড়ে উঠেছে মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাকারবারিদের বিশাল সাম্রাজ্য। মাদক ও চোরাই পণ্যের মালামাল বিক্রিতে জড়িত থাকার অপরাধে বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে ৭টি মামলা রয়েছে। তবুও বেপরোয়া মনিক মিয়া। মানিক মিয়ার বাড়ি হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার চৌমুহনী ইউনিয়নের বেলাপুর গ্রামে। ওই গ্রামের তাহের মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া।
একাধিক মাদক মামলার আসামি হওয়ায় ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার এড়াতে ও পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িতে বসিয়েছেন সিসি ক্যামেরা। তবে সিসি ক্যামেরা বসিয়েও তার শেষ রক্ষা হয়নি। চোরাই পণ্য কেনার অপরাধে বুধবার (১২ জুন) গ্রেপ্তার হন মানিক মিয়া।
স্থানীয় একাধিক সুত্র জানায়, এক সময়ের যার নুন আনতে পানতা ফুড়াত এবং সহজ—সরল মানিক মিয়ার প্রধান ব্যবসা হচ্ছে মাদক আর চোরাই পণ্য হেফাজতে রেখে রমরমা ব্যবসা। চুরি করা পণ্য কেনাবেচা তার অন্যতম পেশা ও নেশা। চোরাই পণ্যের চোর চক্রের সঙ্গে রয়েছে তার গভীর সম্পর্ক। কোন চোর ধরা পড়লে তাকে ছাড়িয়ে আনতেও পিছিয়ে নেই মানিক। মানিকের দুই স্ত্রী’র মধ্যে প্রথম স্ত্রী ছেলে—মেয়ে নিয়ে বসবাস করেন বেলাপুর গ্রামের মানিকের পৈত্রিক ভিটাতে। আর দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে মানিক বসবাস করেন মাধবপুরের চৌমুহনী ইউনিয়নের আরিছপুর (বারইপাড়া) গ্রামে।
তথ্য অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, মোটরসাইকেলে যাত্রী বহনের আড়ালে একাধিক মাদক ব্যবসায়ী এবং চোরাচক্রের সাথে তার (মানিকের) গভীর সখ্যতা গড়ে ওঠে। এরপর অল্প সময়ে ধনী হওয়ার লোভে ছেড়ে দেন যাত্রী বহন। পরে চৌমুহনী ইউনিয়নের আরিছপুর (বারইপাড়া) গ্রামে বসত ঘরের সামনে মার্কেট নির্মাণ করে মুদি মালের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন মানিক। তবে এই দোকানে মুদি পণ্যের চেয়ে মাদক ও চোরাই পণ্যের কেনাবেচার নিরাপদ স্থান হিসাবেই ব্যবহার করা হতো। পাশাপাশি চড়া সুদেও বেশ কিছু টাকা স্থানীয়দের মাঝে লগ্নি করেন মানিক। তার নিকট থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে এলাকা ছেড়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
গত কয়েক বছর আগেও উপজেলার চৌমুহনী ইউনিয়নের বেলাপুর গ্রামের পৈত্রিক ভিটাতে ছোট্ট একটি ঘরে কোনো রকম দিনযাপন করা মানিক হঠাৎ বড় লোক হয়ে যান। গড়ে তুলেন পাকা দালান। সেই দালানে মাদক ও চোরাই পণ্য মজুদ করে চলে তার রমরমা ব্যবসা। প্রতিদিনই বসত ঘরে বসানো হতো মাদকের আসর। তার এমন উত্তানে এলাকার মানুষের মনে নানান প্রশ্ন দেখা দেয়। মাদক ও চোরাই পণ্যের ব্যবসা নির্বিঘ্নে করতে পুলিশের নজরদারি এবং গ্রেপ্তার এড়াতে বাড়িতে বসিয়েছিল সিসি ক্যামেরা। নিজের মোবাইলে তিনি পুলিশের আসা—যাওয়ার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে জানান, সীমান্তবর্তী চৌমুহনী ইউনিয়নের আরিছপুর বারইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মানিক ভারত থেকে ফেনসিডিল, গাঁজা ও ইয়াবা এনে পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে মাত্র ২—৩ বছরের মাথায় কোটিপতি হয়েছেন।
সম্প্রতি চৌমুহনী ইউনিয়নের কমলানগর গ্রামের মাসুকের ঘরে চুরি হওয়ার ঘটনায় মাধবপুর থানায় মাসুকের স্ত্রী শারমিন বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাত চোরদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন।
অভিযোগের ভিত্তিতে গত ১১ জুন মঙ্গলবার মাধবপুর উপজেলার কাশিমনগর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই ফজলুল হকের নেতৃত্বে পুলিশ মানিকের বসত ঘরে অভিযান চালিয়ে চোরাই খাট (পালং) উদ্ধার করে। তার স্বীকারোক্তিতেই বেরিয়ে আসে চৌমুহনী ইউনিয়নের কমলানগর গ্রামের নাসির মিয়ার ছেলে শান্ত ওরুফে কাইল্লা এবং দুলাল মিয়ার ছেলে জীবনের নাম। এরপর শান্ত এবং জীবনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পরে গ্রেপ্তারকৃত জীবনের তথ্যমতে কমলানগর গ্রামের মাসুকের ঘর থেকে চুরি হওয়া মালামাল শান্ত ওরুফে কাইল্লার ঘর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তবে অদৃশ্য কারণে চোরাই মালামাল কেনাবেচার মূলহোতা মাদক ব্যবসায়ী মানিক রয়ে যান ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
চিহ্নিত চোরকারবারি মানিকের ঘর থেকে মালামাল উদ্ধার হওয়ার পরও বুধবার (১২ জুন) সকাল পর্যন্ত গ্রেপ্তার (মানিক) না হওয়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে আলোচনা—সমালোচনার সৃষ্টি হয় এবং স্থানীয়রা থানার অফিসার ইনচার্জকে অবহিত করার পর পুলিশ তাকে গ্রেফতারে তৎপরতা চালায়।
পরবর্তীতে মাধবপুর থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম খানের নির্দেশে বুধবার বিকেল কাশিমনগর পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই দেলোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মানিক মিয়াকে তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। মানিক মিয়াকে গ্রেপ্তারের খবর নিশ্চিত করেন মাধবপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) রাকিবুল ইসলাম খান পিপিএম।
ওসি রাকিবুল ইসলাম খান জানান, গ্রেপ্তারকৃত জীবন ও শান্তকে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠানো হয়েছে। মানিক একজন চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী ও চোরাই পণ্যের জিম্মাদার। তার বিরুদ্ধে ৭টি মাদক মামলা রয়েছে। চোরাই মালামাল কম দামে কিনে বেশি দামে বিক্রি করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।