দিরাই প্রতিনিধি:
ভূয়াবিল ভাউচার দেখিয়ে লাখ লাখ উত্তোলন করে আত্মসাতের অভিযোগ ওঠেছে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইয়াসিন আরাফাত এবং হাসপাতালের প্রধান সহকারী কাম হিসাবরক্ষক ওয়াহিদ মিয়ার বিরুদ্ধে। তাদের বিরুদ্ধে ১৫টি অভিযোগ এনে সম্প্রতি সিলেট বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন মোহাম্মদ সালমান নামের এক ব্যক্তি। অভিযোগকারী নিজেকে দিরাই উপজেলার স্থায়ী বাসিন্দা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
অভিযোগ ও স্থানীয় একাধিক সুত্র জানায়, অভিযোগের তদন্ত করতে বুধবার তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জনকে প্রধান করে ডেপুটি সিভিল সার্জন ও একজন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে রিপোর্ট প্রদানের জন্য বলা হয়েছে।
অভিযোগকারী জানান, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও প্রধান সহকারী হাসপাতালটিকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিনত করেছেন। ভাড়া না দিয়ে হাসপাতালের বাসা দখল করে থাকছেন প্রধান সহকারী ওয়াহিদ মিয়া। ওয়াহিদ মিয়া সম্প্রতি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ থানার একটি মামলায় আট দিন হাজতবাস এবং মাসের পর মাস দিরাই হাসপাতালে অনুপস্থিত থেকেও বেতন ভাতাদি উত্তোলন করছেন।
হাসপাতালের জেনারেটর তিন বছর ধরে নষ্ট হলেও প্রতি মাসে জ্বালানি খরচ উত্তোলন করে পকেটস্থ করছেন তিনি। হাসপাতালের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ আসা বরাদ্দের টাকা নামমাত্র কাজ করে অধিকাংশ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন প্রধান সহকারী ।
স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হাসপাতালের আওতাধীন জগদল ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, ভাটিপাড়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, পেরুয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে কোনো টাকা খরচ না করেই বিভিন্ন সময়ে ভুয়া বিল তৈরি করে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করছেন।
আউটসোর্সিং পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিমা বিশ্বাসের ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বেতন-ভাতা ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আত্মসাতের চেষ্টা করেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। কিন্তু তৎকালীন সিভিল সার্জন বিষয়টি অবগত হলে প্রতিমা বিশ্বাসকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন ডা. ইয়াসিন আরাফাত ও ওয়াহিদ মিয়া।
আউটসোর্সিং কর্মী বদরুল আলমের ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বেতন ভাতার ১ লাখ ৯৩ হাজার টাকা আউটসোর্সিং কর্মী আলী নুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পোস্টিং দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।
পরিচ্ছন্নতাকর্মী প্রতিমা বিশ্বাস জানান, ‘পেটের দায়ে দিন-রাত কাজ করেছি। তবুও ইয়াসিন আরাফাত স্যার হাসপাতাল থেকে বের করে দিতে চেয়েছিলেন। তখন আরএমও রায়হান স্যারের শরণাপন্ন হয়ে কাকুতি-মিনতি করে সিভিল সার্জন স্যারকে অবগত করি। এরপর আমাকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে স্ট্যাম্পে লিখিত রাখেন, যাতে কাউকে কিছু না বলি। ২৩ সালের একটি টাকাও পাইনি।’
আউটসোর্সিং কর্মী শাখাওয়াত বলেন, ‘আমাকে এক মাসের বেতন বাবদ ১৬ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা স্যার রেখে দিয়েছেন।’
অভিযোগ রয়েছে, ডা. ইয়াসিন আরাফাত দিরাইয়ে যোগদান করার পর থেকে ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মিলিয়ে প্রভাব খাটিয়ে সপ্তাহে দুয়েক দিন দিরাইয়ে এলেও তাড়াহুড়ো করে সিলেটের বিশ্বনাথে চলে যেতেন রোগী দেখার জন্য। মাঠ পরিদর্শনে না গেলেও মিথ্যা তথ্য দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা বিল আত্মসাৎ করছেন। সরকারি গাড়ি সিলেটে নিজের বাসায় রেখে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন এবং জ্বালানি বিল উত্তোলন করছেন।
সুত্র আরও জানা যায়, তার বিরুদ্ধে দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় বার বার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তাকে সিলেটের বিশ্বনাথ থেকে দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসাবে বদলী করা হয়। বদলীর পরও তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বদল হয়নি। দিরাই হাসপাতালে ডিউটি না করে সিলেটের বিশ্বনাথে নিয়মিত রোগী দেখতেন। সে বিষয়েও দৈনিক ইনকিলাবে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।
অভিযুক্ত প্রধান সহকারী ওয়াহিদ মিয়া বলেন, ‘আমি দুর্নীতি করিনি। হাজিরা খাতায় নয়, আমি প্রতিদিন বায়োমেট্রিক মেশিনে উপস্থিতি দিয়েছি। আমি থানায় ছিলাম, জেল হাজতে নয়।
দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘অভিযোগগুলো মোটেও সঠিক নয়। আমি এক দিনও হাসপাতালে অনুপস্থিত ছিলাম না। অফিসিয়ালি মিটিং থাকলে বাহিরে থাকতে হয়। দুই বছর ৮ মাসে অনেক ভালো কাজ করেছি। এমন অভিজ্ঞতার জন্য প্রমোশন পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। আমি হাসপাতালের অফিস সময়ের পরই বিশ্বনাথ গিয়ে রোগী দেখি। প্রধান সহকারী হাজতে ছিল কি না আমার জানা নেই, তবে তার ফোন তিন-চার দিন বন্ধ ছিল। বিষয়টি সিভিল সার্জনকে জানিয়েছি।’
সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং প্রধান সহকারী কাম হিসাব রক্ষকের বিরুদ্ধে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। শিগগির তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।