আন্তর্জাতিক সিসা দুষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষ্যে সিসা দূষণ বন্ধ হলে, বাড়বে শিশু বুদ্ধি—বলে এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সিলেটের বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা সমূহ র্যালী মানববন্ধন ও আলোচনা সভা সম্পন্ন করেছে।
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইয়ুথনেট গ্লোবাল ও পিওর আর্থ বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে ইউনিসেফ এর আর্থিক সহযোগিতায় সপ্তাহটি পালন করা হয়। শুক্রবার বিকালে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে বিশাল র্যালী, মানববন্ধন ও আলোচনা সভার মাধ্যমে সপ্তাহটি পালন করা হয়। র্যালীতে শতাধিক যুবক যুবতীরা, ইয়ুথনেট গ্লোবালের স্বেচ্ছাসেবী, পিওর আর্থ বাংলাদেশ ও ইউনিসেফের প্রতিনিধিবৃন্দসহ সাধারন মানুষ অংশ গ্রহন করে।
এ ছাড়াও সিলেটের বিভিন্ন যুব সংগঠন, সুশীল সমাজ সংগঠন ও স্থানীয় এনজিও প্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, নীতিনির্ধারণী মহল, পরিবেশ অধিকারকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় সবার হাতে ছিল সিসা দূষণ প্রতিরোধমূলক ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড যুক্ত “সিসা দূষণ প্রতিরোধে, আমরা আছি একসাথে”— সহ বিভিন্ন স্লোগান। সিসার বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সর্বস্তরের জনসচেতনতা বাড়ানো, সরকারী ও নীতিনির্ধারণী মহলকে এ বিষয়ে আইন ও নীতিমালার যথাযথ প্রয়োগ করে কঠোর ও কার্যকরী আইনী পদক্ষেপ নিতে জোর দেয়া হয়েছে। এ সময় বক্তারা বলেন, জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানে চলতি বছর ২০শে অক্টোবর থেকে ২৫শে অক্টোবর পর্যন্ত সপ্তাহটি পালন করা হবে।
এবারের দিবসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাধারণ মানুষ, সরকার, সুশীল সমাজ, স্বাস্থ্যকর্মী, বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্যদের মাঝে সিসা দূষণের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরা এবং শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশে সিসা দূষণের বিস্তৃতি ভয়াবহ পর্যায়ে থাকা সত্ত্বেও এর প্রভাব ও উৎস নিয়ে সাধারণ জনগণ ও নীতিনির্ধারণী মহলে সচেতনতা খুবই সীমিত। যার ফলে, বিশ্বে সর্বোচ্চ সিসা দূষিত দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশের অবস্থান হওয়ায় মানুষদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু অর্থাৎ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুর রক্তে উচ্চ মাত্রার সিসা আছে। সিসার বিষক্রিয়ার শিকার হলে শিশুদের বুদ্ধি কমে যায়, পড়ালেখায় পিছিয়ে পরে, মনোযোগে সমস্যা হয়, আচরণগত সমস্যা যেমন মেজাজ খিটখিটে, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরার লক্ষণ দেখা যায়। প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সিসা দূষণের কারণে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ (সিভিডি) বা হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই সিসার কারনে ১ কোটি ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে। গর্ভবতী নারীদের রক্তে সিসার উপস্থিতির কারণে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসবসহ নানা ঝুঁকির সৃষ্টি করে। বুদ্ধিমত্তা হ্রাস ও হৃদরোগে মৃত্যুর ফলে দেশের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৮,৬৩৩ মিলিয়ন ডলার। যার কারণে দেশে বছরে ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি এমন অনেক জিনিসপত্রে সিসা মেশানো থাকতে পারে যেমন: দেয়াল রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের বাসনপত্র, মসলা, শিশুদের খেলনা, কসমেটিক্স বা প্রসাধনী, চাষকৃত মাছের খাবারসহ আরও অনেক কিছুতেই সিসা মেশানো হচ্ছে। অনিরাপদে, খোলা জায়গায় যখন সিসা—অ্যাসিড ব্যাটারি ভাঙ্গা ও সিসা গলানো হয় রিসাইক্লিং এর জন্য তখন সিসা পরিবেশে উন্মুক্ত হয়ে দূষণ ছড়ায়। র্যালি, মানববন্ধন ও আলোচনা শেষে অংশগ্রহণকারীরা সরকার ও নীতিনির্ধারকদের প্রতি পাঁচ দফা দাবী উত্থাপন করেন। দফাগুলোর মধ্যে ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্য যেমন অ্যালুমিনিয়ামের রান্নার বাসনপত্র, দেয়াল রং, শিশুদের খেলনা ইত্যাদিতে ক্ষতিকারক ভারী ধাতু সিসা মেশানো বন্ধ করতে হবে।
বিভিন্ন জিনিসের নিরাপদ মানদণ্ড ও কঠোর মনিটরিং নিশ্চিত করতে হবে। দেশের আনাচে—কানাচে গড়ে ওঠা অনিরাপদ সিসা—অ্যাসিড ব্যাটারি কারখানাগুলো বন্ধ করে বা রূপান্তরিত করে নিরাপদ ও পরিকল্পিত রিসাইক্লিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অবৈধ সিসা ব্যাটারি কারখানার কারণে দূষিত এলাকাগুলো চিহ্নিত করে মনিটরিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং সিসা দূষিত অঞ্চলগুলো পরিষ্কার করা, সিসা দূষণ প্রতিরোধে বিদ্যমান আইন ও নীতিমালাগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে নতুন আইন প্রণয়ন করা এবং আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং সকল অংশীদ্বারদের সাথে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সিসা দূষণের উৎস ও ভয়াবহতা সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষা করতে সরকারকের কার্যকর ভুমিকা নিতে হবে।