বিশেষ প্রতিনিধি:
অতীতের মতো সাংবাদিকরা যেন দলীয় দাসে পরিনত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং সংবাদপত্র গণতন্ত্রের চোখ বলে মন্তব্য করে বিএফইউজে’র মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, ‘সংবাদপত্র হচ্ছে ওয়াসডক। এর মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবী আমাদের সামনে ভেসে ওঠে।’ সংবাদপত্রের প্রধান কাজ হলো সমাজ জীবনের ত্রুটিবিচ্যুতি পর্যালোচনা করে পথনির্দেশ দেয়া। এজন্যই সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ব বলা হয়।’
শনিবার বিকেলে সিলেট প্রেসক্লাব মিলনায়তনে সিলেট মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের উদ্যোগে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সাবেক সভাপতি ও বীরমুক্তিযোদ্ধা মরহুম রুহুল আমিন গাজীর স্মরণে নাগরিক শোকসভা ও দোয়া মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন।
সিলেটের সিনিয়র সাংবাদিক এনামুল হক জুবেরের সভাপতিত্বে ও এসএমইউজের সাধারণ সম্পাদক খালেদ আহমদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি’র বক্তব্য রাখেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো: আলীমুল ইসলাম, সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, সিলেট মহানগর জামায়াতের আমির মো: ফখরুল ইসলাম, সিলেট ইবনে সিনা হাসপাতাল এর চেয়ারম্যান ও সিলেট মহানগর জামায়াতের সভাপতি মাওলানা হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন—ডিইউজের সভাপতি মো: শহিদুল ইসলাম ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সিলেট আহ্বায়ক ডা. শামীমুর রহমান।
শোকসভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন এসএমইউজের সভাপতি মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বদর। দোয়া পরিচালনা করেন মাওলানা শাহ মো: নজরুল ইসলাম। এ ছাড়া শোকসভায় বক্তব্য রাখেন সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সময় টিভি’র বিশেষ প্রতিনিধি ইকরামুল কবির ইকু, সাধারন সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম, এশিয়ানটিভি’র সিলেট ব্যুরো প্রধান শাহজাহান সেলিম বুলবুল, দৈনিক সংগ্রামের সিলেট ব্যুরো প্রধান মো: কবির আহমদ, নয়াদিগন্তের সিলেট ব্যুরো প্রধান আব্দুল কাদের তাপাদার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা।
কাদের গনি চৌধুরী আরও বলেন, ‘সংবাদপত্রকে বলা হয় চলমান ইতিহাস। সংবাদপত্রের সাহায্যে চলমান পৃথিবীর বিচিত্র ঘটনার সাথে আমরা সহজে পরিচিত হতে পারি। তাই চলন্ত ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে আমাদের প্রস্তুত হতে হবে সুন্দর আগামীর জন্য। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রানান্ত চেষ্টা করছে। সে ক্ষেত্রে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। ‘বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির যুগে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণমাধ্যমের কোনো না কোনো ভূমিকা রয়েছে। মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে প্রযুক্তি এবং সাহিত্য—সংস্কৃতির বিভিন্ন বিকাশ মিডিয়ার মাধ্যম প্রকাশিত হয়েছে। জনগণকে সচেতন করার দায়িত্ব মিডিয়ার। জনগণের বাক—স্বাধীনতা বিকাশে মিডিয়ার ভূমিকা অপরিসীম। মিডিয়া সরকারসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমালোচনা করে তাদের সংশোধনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব বিকাশে গণমাধ্যমকে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে গণমাধ্যমই পারে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। রাষ্ট্রের সবগুলো প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ বা নিষি্ক্রয় হয়ে গেলেও মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল হিসেবে যে প্রদীপ শিখাটি জ্বলতে থাকে, তা হলো গণমাধ্যম।’ গণমাধ্যমকে দলীয় দাসত্ব থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘সংবাদপত্র হলো একটা দেশ, সমাজ ও জাতির মুখপাত্র। একটা দেশের জাতি কতটা বাকস্বাধীনতা ভোগ করে তা গণমাধ্যমকে দেখলেই বোঝা যায়। এর জন্য একজন স্বাধীন ও মুক্তমনা সাংবাদিককে তথ্যের জন্য কঠিন ও কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। দুরন্ত ও সাহসী হতে হয়। অনেক সময় সাহসিকতার বা ভয়ের কারণে সত্য নিউজ করতে চায় না অনেক সাংবাদিক বা গণমাধ্যম। অন্যায় নিপীড়ন দুর্নীতি দেখেও চুপ থাকে যারা তারা কখনও সাংবাদিক হতে পারে না। পরিবারের কথা ভেবে অনেকে চুপসে যায়। ফলে সত্য থেকে যায় আড়ালে। প্রকৃতপক্ষে একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিক কখনো সত্যকে আড়াল করতে পারে না। তারা কখনো লোকভয় ও রাজভয় করে না। সব সময় তারা অনুসন্ধানী হয়।’ ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার গেল ১৫টি বছর সাংবাদিকদের কলম ও মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। কিছু চাটুকার সাংবাদিকদের কারনেই দেশের প্রকৃত সাংবাদিকদের মুল্যায়ন করা হয় না।
তিনি আরও বলেন, ‘দেশ—বিদেশে এমন অনেক সাংবাদিক রয়েছে, যারা সত্য চাপিয়ে যেমন আলোড়ন তৈরি করেছিল। তেমনি জীবনও দিতে হয়েছিল। বব অ্যাডওয়ার্ড, সেন্ড লুইস পেস্ট ডিসপ্যাচ, উইল ফ্রেড ব্রুচেট, পিটার আর্নেস্ট, জন পিটার, এলিজা প্যারিস লডজয়, মার্গারেট ব্রুক হোয়াইটসহ প্রমুখ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকর্মীরা বিখ্যাত হয়ে আছেন সত্য প্রকাশের জন্য। বাংলাদেশেও অনেক দুরন্ত সাহসী সাংবাদিক ছিলেন, যারা ১৯৫২ ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধেও ভূমিকা রেখেছিল। তাদের মধ্যে জহুর হোসেন চৌধুরী, মাওলানা মুহাম্মদ আকরাম খাঁ, আব্দুস সালাম, আবু জাফর, রিয়াজুদ্দিন আহমদ, গিয়াস কামাল চৌধুরীসহ প্রমুখ প্রবীণ ও নবীন গণমাধ্যমের সাহসিকতা হিসেবে অমর হয়ে আছেন। মাহমুদুর রহমান, শফিক রেহমান, রুহুল আমিন গাজী জেল জুলুম হামলা ও মামলার স্বীকার হয়েছেন, তবুও তারা পিছপা হননি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাংবাদিকতা অত্যন্ত কঠিন পেশা। রক্তচক্ষু উপেক্ষার সাহস না থাকলে সাংবাদিকতা করা যায় না। সত্যিকথা বলতে কি চারপাশে কেবল দাসত্ব আর তোষামোদি দেখে দেখে আমরা নির্বিকার হয়ে পড়েছি। সাংবাদিকতায় আমরা যাদের পরম্পরা বহন করছি, সেই গৌরবের ইতিহাস আমাদের সামান্যই প্রভাবিত করছে।’
তিনি বলেন, ‘সমকালীন সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার অন্দরে প্রবেশ করে যদি আমরা আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে স্মরণ করি তবে লজ্জায় মাথা নত হতে হয়। সাংবাদিকতার মানস—মূল্যবোধ আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে! একটি স্বাধীন দেশে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমরা স্বাধীনতার জন্য রীতিমতো ‘কান্নাকাটি’ করছি। অথচ সত্য উচ্চারণে চিরকালই বাধা আসবে, গ¬ানি থাকবে, সত্যকে আলিঙ্গন করতে হবে, সাংবাদিকতায় এটিই বাস্তবতা। সেখানে সত্য উচ্চারণের পথ সহজ হবে তা আমরা আশা করি কি করে? অতীত যেন আমাদের ভৎর্সনা করে বলছে, ‘বাধাকে, রক্তচক্ষুকে ডিঙিয়ে যাওয়ার সাহস যদি না থাকে তবে এ পথ তোমার নয়।’
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আলিমুল ইসলাম বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সদ্য প্রয়াত সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ছিলেন একজন আপসহীন সাংবাদিক নেতা। সাংবাদিকদের রুটি—রুজির আন্দোলনে তিনি সব সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তার মতো এমন সাহসী নেতৃত্ব সাংবাদিক জগতে বিরল। দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা—সার্বভৌমত্ব যখনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তখনই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। সর্বশেষ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় অসুস্থ থাকার পরও তিনি রাজপথে নেমে সাংবাদিকদের সাহস জুগিয়েছেন। তার মৃত্যু সাংবাদিকতা জগতে একটি শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।’
ওবায়দুর রহমান শাহীন বলেন, ‘সাংবাদিকদের অন্যতম এ নেতার কিডনির সমস্যা ছিল। এরপরও ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার তাকে গ্রেফতার করে ১৭ মাস জেলে আটকে রেখেছিল। সেখানে তাকে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি। চিকিৎসার অবহেলা করে তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এজন্য স্বৈরাচার আওয়ামী সরকার এবং ওই সময় দায়িত্বপালন করা কারাগারের জেলার ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা উচিত। তাদের গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে।’
শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘রুহুল আমিন গাজী ভাই নেই, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই তাকে চিনি। তিনি ছিলেন একজন সাহসী সাংবাদিক নেতা। প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। সর্বশেষ ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের আগের দিনও তিনি অসুস্থ অবস্থায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে পেশাজীবীদের আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন।’
সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘রুহুল আমিন গাজীর একটি কিডনি কেটে ফেলতে হয়েছিলো। এ ধরনের রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু তাকে জেলে আটকে রেখে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি। তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ২৪’এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি মূলত একজন শহীদ।’
জামায়াতে ইসলামীর আমির হাবিবুর রহমান বলেন, ‘রুহুল আমিন গাজী ভাইকে হারিয়ে একটি শূন্যতা অনুভব করছি। তার মত এমন সৎ, সাহসী নেতৃত্ব বিরল। তার মধ্যে কোনো মৃত্যুভয় ছিলো না। কোনো ভীরুতা ছিলো না। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে কালাকানুনের প্রতিবাদ করেছেন। এজন্য তাকে ১৭ মাস কারাগারে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তার পরিবারকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।’
আলোচনা শেষে মরহুম রুহুল আমিন গাজী’র আত্মার শান্তি ও মাগফিরাত কামনা এবং শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে দোয়া পরিচালনা করা হয়।