বিশেষ প্রতিনিধি:
দীর্ঘ ১৪ বছর পর সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয়ে জনবল নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। গেল বৃহস্পতিবারে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ অর্ধশতাধিক পরীক্ষার্থী সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। সকাল ১০টা থেকে চাকুরী প্রার্থীদের অফিসের বারান্দায় ভীড় করতে দেখা গেছে। অভিযোগকারীরা জানান, বর্তমান সিভিল সার্জন ও স্বাস্থ্য বিভাগের সিলেট বিভাগীয় পরিচালক যৌথভাবে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ব্যাপক অনিয়ম ও বিশৃংখলার মধ্য দিয়ে নিয়োগ দিয়েছেন। স্বাস্থ্য সহকারী পদে পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতা শুরুর পর থেকেই নানান বিষয়ে সন্দেহ হচ্ছিল তাদের। নিয়োগ পরীক্ষার লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর সকলেরই সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এ কারণে পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। সুত্র জানায়, সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিসে ২০১৮ সালের ১১ ডিসেম্বর ও ২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট দুটি পৃথক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ২৩৬ জন কর্মকর্তা কর্মচারী নিয়োগ আহ্বান করা হয়। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য সহকারী পদে ১৯৩ জন, সাট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ১জন, অফিস সহকারী ১৬ জন, পরিসংখ্যানবিদ ৮ জন, কীটতত্ত্বীয় টেকনেশিয়ান ২জন, স্টোরকিপার ৮জন ও ড্রাইভার ৮ জন।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী সব কয়টি পদে ৩৮ হাজার ৩১৪ জন নিয়োগ প্রার্থী আবেদন করে। তার মধ্যে কেবল স্বাস্থ্য সহকারী পদে আবেদন করেছিল ১২ হাজার ৫৯ জন। লিখিত পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করেছিল ১০ হাজার ২৬৮ জন চাকুরীপ্রার্থী। উত্তীর্ণ হয়েছিল ১ হাজার ৫২ জন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা শেষে গেল ৭ মে ১৯৩ জনকে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ জানিয়ে দেওয়া হয় ।
চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশের পর নিয়োগ বঞ্চিত অর্ধশতাধিক চাকুরী প্রার্থী পরীক্ষায় ব্যাপক অনিয়ম—বিশৃঙ্খলা হয়েছে দাবি করে লিখিত অভিযোগ করেছিল। পরীক্ষার্থীরা জানায়, লিখিত পরীক্ষার ফলাফল গেল ২৫ এপ্রিল প্রকাশের পর ২৬ এপ্রিল ও ২৯ এপ্রিল দুই দফায় সংশোধিত ফলাফল প্রকাশ করায় নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির বিষয়টি চলে আসে। পরে চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেছে নানান অনিয়ম ও ভুলে ভরা ছিল তাদের প্রকাশিত ফলাফলে। নিয়োগ প্রক্রিয়াটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড ভিত্তিক হলেও নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন বহু ওয়ার্ডে। এই অবস্থায় পুরো বিষয়টির পুনঃ নিরীক্ষণ দাবি করেছেন নিয়োগ প্রার্থীরা।
সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগরের বংশিকুণ্ডা ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা খোকন মিয়া সিলেট এমসি কলেজ থেকে সমাজ বিজ্ঞানে অনার্স—মাস্টার্স শেষ করে ২০১৮ সালে স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিলেন। তিনি জানান আমি ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। আমাদের ওয়ার্ডের চারজন নিয়োগ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে কিন্তু নিয়োগ হয়েছে তিন নম্বর ওয়ার্ডের আরেক জনের। অথচ এটাই আমার শেষ পরীক্ষা ছিল। আমার বয়স সীমা শেষ, আমি আর সরকারি চাকুরিতে আবেদন করতে পারবো না।
শান্তিগঞ্জের পশ্চিম পাগলা ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা একজন নিয়োগ প্রার্থী (নাম প্রকশে অনিচ্চুক) জানান, তিনি সিলেটের এসসি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স—মাস্টার্স শেষ করেছেন দুই বছর আগে। তার চাকুরির বয়সসীমা শেষ। তার ওয়ার্ড থেকে চারজন পরীক্ষার্থী লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তার মধ্যে ফলাফলের সময় অন্য আরেকজনকে এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা দেখিয়ে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে এবং তাকেই মৌখিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। তার কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ নিয়ে সিভিল সার্জন ও সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক মোটা অংকের অর্থ নিয়ে শৃংখলা ভঙ্গ করে তাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এই নিয়োগ বাতিল করা দরকার।
আরেকজন নিয়োগ প্রত্যাশী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানান, লিখিত পরীক্ষার ফল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইসবুকে প্রকাশ করা হয় ২৫ এপ্রিল। ২৬ এপ্রিল আবার সংশোধিত ফলাফল দেখিয়ে জগন্নাথপুরের দুইজনের নম্বর সংযুক্ত করে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। ২৯ এপ্রিল আবার দিরাইয়ের কয়েকজনকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। দুটি সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে। এই দুই তালিকা থেকেই দুইজন মৌখিক পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়েছে। এই পরীক্ষার্থীরা জানান, আমরা মনে করছি দুইজনকে চাকুরি দেবার জন্যই এভাবে অন্যায়ভাবে সংশোধনী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। ওই সময় দুইজনের বাইরে অন্যদের রোল দেওয়া হয়, প্রক্রিয়াটিকে বিশ^াসযোগ্য করার জন্য। যাতে কেউ সন্দেহ না করেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কাঠইর ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ড থেকে চারজন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। কিন্তু নিয়োগ হয়েছে পাঁচ কিলোমিটার দূরের অন্য ওয়ার্ডের একজনের জানিয়ে লিখিক অভিযোগ দিয়েছেন চাকুরী প্রার্থী এই ওয়ার্ডের মনিকা তালুকদার ও বাবলু দাস। এরা দুজনেই জানিয়েছে, এখানে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে। আমরা বিষয়টির সংশোধন চাই।
বিশ^ম্ভরপুর উপজেলার সলুকাবাদ ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের সুজলা আক্তার ও একই ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের সালমা আক্তারও একই ধরণের অনিয়মের অভিযোগ করে পরীক্ষাসহ সকল কাগজপত্র পূনঃ নিরীক্ষার দাবি জানিয়েছেন।
বৃহস্পতিবার ছাতকের নোয়ারাই ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের একজন চাকুরী প্রার্থী সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, নোয়ারাই ইউনিয়নের পুরাতন দুই নম্বর ওয়ার্ড (বর্তমানে ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ড) এর বাসিন্দা দেখিয়ে ছাতক পৌরসভার বাসিন্দা মৃগাংক নাগ মিঠু কে চূড়ান্ত ফলাফলে উত্তীর্ণ দেখানো হয়েছে। তার এই নির্বাচনেও নিয়োগ প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে অভিযোগকারীরা দাবি করেন।
স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে জেলা সদরে অনুষ্ঠিত বড় এই নিয়োগ পরীক্ষা আয়োজক কমিটির সভাপতি ছিলেন, সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক এবং সদস্য সচিব ছিলেন সুনামগঞ্জের সিভিল সার্জন। অন্য আরও তিনজন সদস্য ছিলেন।
সিভিল সার্জন অফিসের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জানান, বৃহস্পতিবারই ২৫ জন চাকুরি প্রার্থী স্বাস্থ্য সহকারী পদে নিয়োগে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে উল্লেখ করে অভিযোগ দাখিল করেছেন। এর আগে বুধবার আরও কয়েকজন অভিযোগ জানাতে এসেছিলেন।
সিভিল সার্জন ডা. আহম্মদ হোসেন জানান, আমরা দক্ষতার সঙ্গে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। ভুলত্রুটি থাকলে চূড়ান্ত ফলাফলে উত্তীর্ণ হলেও পরে তা সংশোধন করা হবে। কেউ ভুল তথ্য দিলে গোয়েন্দা রিপোর্টে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। লিখিত পরীক্ষার সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি জগন্নাথপুর ও দিরাইয়ের দুইবার প্রকাশ এবং ওই নম্বর থেকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এর নম্বরে ডিজিট ব্যবধান ছিলো, শূন্য কম বেশি ছিল। এসব কারণে সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। আমাদের কোন খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না।
এতো ভুল কেন হলো, এমন প্রশ্নের জবাবে সিভিল সার্জন জানান, আমাদের লোকজন নিয়োগ পরীক্ষায় এতোটা দক্ষ ছিল না। তাছাড়া আমাদের অনেক স্টাফদের সন্তান পরীক্ষা দিচ্ছিল। এ জন্য তাদের নিয়োগ কার্যক্রম থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। নিয়োগ পরীক্ষায় কোন অনিয়ম করা হয়নি।
এ ব্যাপারে সিলেট বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালক ডা: আনিসুর রহমান জানান, পুরাতন ওয়ার্ড ও নতুন ওয়ার্ডের ত্রুুটির কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে এবং আমরা মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদেরকে পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ দিয়েছিলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে পূণ:সংশোধনী নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের সুযোগ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান এবং নিয়োগ পরীক্ষায় কোন ধরনের অনিয়মের সুযোগ নাই। কাহারো কোন অভিযোগ থাকলে তা যাচাই করে দেখা হবে। সুত্র: দৈ.সু:খবর।