শহরের স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীদের বাসা থেকে স্কুল পর্যন্ত পৌছাতে যেসব বিড়ম্বনার মুখে পরতে হয় তার প্রায় ৭০ ভাগই বখাটে ও উঠতি “রোমিওদের” উত্তক্ত্যকরণের ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন অভিভাবকরা। তাদের অভিযোগের যেনো অন্ত নেই। সুনামগঞ্জ শহরের সরকারি সতিশ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এমন অভিযোগের পক্ষে জোর দিয়েছেন। তাদের মতে ছাত্রীরা এই বিড়ম্বনার মুখে পরে শিক্ষা গ্রহণের মনোযোগ থেকে সরে যাওয়ার পাশাপাশি একটা ভীতির মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠছে। এ অবস্থায় বখাটেপনা ঠেকাতে পুলিশের তেমন অ্যাকশন চোখে পড়ে না বলেও অভিযোগ করেছেন তারা।
হাওরাঞ্চলের কথার অনুসন্ধান বলছে‘ সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ১০টা এবং দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সময়ে সুনামগঞ্জ শহরের হোসেন বখত চত্তর (পূর্বের নাম বক পয়েন্ট) এলাকায় উঠতি বখাটেদের নিয়মিত আড্ডা চোখে পরছে। একই সময়ে শহরের এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এর সম্মুখে বখাটেদের চলাচল ও স্কুলের ছাত্রীদের উদ্দেশ্য করে ডাকাডাকি এবং নানা কটুক্তি করার অভিযোগ রয়েছে অভিভাবকদের। টিজিংয়ের শিকার ছাত্রীদের অনেকেই ভয়ে শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ জানান না এবং তাদের বেশিরভাগই বখাটেদের প্রতি প্রতিবাদ জানাতেও অনেকটা অসহায়।
সুনামগঞ্জ শহরের নতুনপাড়া এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৭ম শ্রেণী পড়ুয়া এক ছাত্রী অভিযোগ করে বলেন “ আমি পড়ি এসসি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, স্কুলটা আমার হলেও স্কুলের গেইটটার সামনেও আমি যেতে পারিনা, বাসা থেকে একটা ভয় নিয়ে দ্রুত আরও দ্রুত ছুটে আসতে হয় , কোন রকমে স্কুলের গেইটের ভেতর ঢুকে গেলেই যেনো বাঁচি, এইটা কেন হবে? শহরে কি পুলিশ নাই?
এই ছাত্রী আরও বলেন‘ আমি বক পয়েন্টে সকাল থেকেই বখাটেরা জটলা হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখি, টিফিন টাইমে দোকানে গেলে এরা নানা বাজে কথা বলে, এসব কথা এতো খারাপ যে বাসায় আব্বুকেও বলা যায়না- শিক্ষকদেরকে কিভাবে বলবো?, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব বখাটেরা প্রতিদিনই আড্ডা দেয় দলবল নিয়ে, কিন্তু পুলিশের গাড়ি রাস্তা দিয়ে যায় আর আসে, এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে দেখিনা।”
এই ছাত্রীর মতো অসহায়ত্ব নিয়ে কোনরকমে স্কুলে যাতায়াত করছে অন্যান্য ছাত্রীরাও। যা তাদের বক্তব্যেই উঠে এসেছে। হাওরাঞ্চলের কথার অপরাধ বিষয়ক বিভাগের প্রতিবেদক টিমের ক্যামেরায় এসব বখাটেদের আড্ডার চিত্রও ধরা পরেছে । ছাত্রীদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে চালানো অনুসন্ধানে দেখা যায়। বুধবার দুপুর ১২টা ৩৪মিনিটে শহরের হোসেন বখত চত্তর এর পূর্বাংশের রেলিংয়ে জটলা পাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে একদল বখাটে। যাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ থেকে ২২ এর মধ্যে। উঠতি এই বখাটে টিমের প্রায় সবাই স্কুল পড়ুয়া ছাত্রীদের চলাচলের উপর নজর রাখছে। একজন স্কুলব্যাগ কাধে নিয়েই দাড়িয়ে। তাদের মাঝখানে বসে আছে ২জন। এই টিমের নেতৃত্ব বা শক্তি এই দুজন।
ঘড়িতে সময় ১২টা ৩৯ মিনিট। সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী পার্শ্ববর্তী দোকানে ফুল কিনতে আসায় তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলছিলো এই বখাটেরা। ওই ছাত্রী নিজেই তাদের কটুক্তির প্রতিবাদ করেন এবং সেখান থেকে স্কুল অভিমুখে ফিরে যান। এই ঘটনা ক্যামেরাবন্দি করতে এগুলে প্রতিবেদককে নজরে আসে বখাটেদের। সঙ্গে সঙ্গেই স্থান ত্যাগ করে বখাটেরা কমরেড বরুণ রায় সড়ক ধরে সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় অভিমুখে হাটতে থাকে। ১২টা ৫২ মিনিটে তারা দুইটি রিকশায় ৮জন উঠেপরে। এই দুটি রিকশা ছাত্রীদের স্কুলের সামনে দিয়ে পর পর দুইবার একই সড়কে প্রদক্ষিণ করে। এই চিত্র ধারণ করতে সক্ষম হয় হাওরাঞ্চলের কথা।
এই বখাটে দল ছাড়াও শহরের মোড়ে মোড়ে অসংখ্য উঠতি ও চিহ্নিত বখাটেরা প্রতিদিন আড্ডা দিচ্ছে অনেকটা প্রকাশ্যে। সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী শবনম (ছদ্বনাম) বলেন‘ স্কুলের সামনে আগে দেয়াল ছিলো, ওই দেয়ালের উপর দিয়ে উকি দিয়ে নাম ধরে ডাকাডাকি করতো বখাটেরা, এখন আরও বরো সমস্যা, স্কুলের নতুন ভবন হচ্ছে, এই সুযোগে ফাঁক ফোকর দিয়ে যা তা কথা বার্তা, ফুল নিয়ে আসে, ফুল নিতে বলে, রিকশার উপরে উঠে আমাদেরকে দেখে, তাদের ডাকাডাকিতে সাড়া না দিলে গালি দেয়”।
তিনি আরও বলেন “রাস্তা দিয়ে তো হাটাই যায়না, পয়েন্টে পয়েন্টে বখাটেরা, তাদের যা স্টাইল, চুল কাটার ধরণ দেখলেই তাদের পরিবারের অভিভাবক পর্যায়ে কি অবস্থা বুঝা যায়, পেন্ট দেখবেন ছিড়া ছিড়া, কানে রিং পরে, ঠোটে তো সিগারেট আছেই, এই শহর যেনো তাদের, আমরা নারী হয়ে জন্মে অসহায়, পুলিশ করছে কি? এই প্রশ্নের যেনো উত্তর নেই”।
শহরে বখাটেদের আড্ডা শুধু স্কুল বা কলেজ এলাকাতেই নয়। শহরের প্রিয়াঙ্গণ মার্কেট এলাকায় পণ্য সামগ্রীর প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসা নারীদের টার্গেট করে নিয়মিত আড্ডা চোখে পরছে। কেবল দিনের আলোতেই নয়। এই এলাকাসহ শহরের পাড়া মহল্লাগুলোর পয়েন্ট ও শহরের মোড়ে মোড়ে বখাটে ও উঠতি মাদকসেবীদের আড্ডা এখন অনেকটা অপেন সিক্রেট। তাদের ব্যপারে অভিযোগ করতেও সাহস করেননা সাধারণ মানুষ। রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের ব্যকআপ সহ পাড়া মহল্লার কথিত বড়ভাইদের ছত্রছায়ায় থেকে দিন রাত বখাটেপনা চালিয়ে যাচ্ছে বিপথে যাওয়া কিশোর-তরুণ ও যুবকরা।
অভিভাবকরা মনে করেন এখনই আইন শৃংখলা বাহিনীর অভিযান জরুরী। অন্যথায় অপরাধ ক্রমশ ছড়িয়ে পরার পাশাপাশি বাড়বে বখাটেদের দাপট। সংকুচিত হবে জনচলাচলের স্বাভাবিকতা। বাড়বে নারী ও স্কুলগামী ছাত্রীদের ভয়।
সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের এক ছাত্রীর অভিভাবক সুলতানা বেগম বলেন“ ইদানিং শহরের প্রত্যেকটা এলাকাতেই বখাটে ছেলেদের উৎপাত বেড়ে গেছে, পুলিশের তেমন কোন সক্রিয়তা দেখিনা এদেরকে নিবারনের, মেয়েরা রাস্তাঘাটে বেড়হলে আমরা বাসায় থেকেও একটা চিন্তার মধ্যে থাকতে হয়, আর মোটরসাইকেল নিয়ে বখাটেদের টানাটানি তো আছেই, রিকশা নিয়ে কোথাও গেলেও শান্তি নাই, আর সন্ধ্যার পর মার্কেটে কিছু কিনতে বেড়ুলে একসঙ্গে ৭টা ৮টা করে ছেলে একজায়গায় দাড়িয়ে বসে আড্ডা আর সিগারেটে ধোয়া ছাড়ার দৃশ্য , এদের যেনো কোন কাজ নেই, এদের অভিভাবকরাও যেনো তাদের কোন খোজ রাখেনা, আগে দেখতাম বক পয়েন্টে পুলিশ থাকতো, বখাটেদের উৎপাত কিছুটা কম ছিলো, এখন তো এরা কাউকেই পরোয়া করেনা, পুলিশের তেমন ভুমিকা নেই বললেই চলে’।
সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসিমা রহমান বলেন “ আমরাতো সব সময়ই বলে আসছি আমাদের মেয়েরা স্কুলে আসতে ও যেতে কি পরিমান টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন সেটা দেখার যেনো কেউ নেই, আমাদের মেয়েরা স্কুলে ঢুকে গেলেও রাস্তা থেকে বাজে কথা বার্তা বলে যাচ্ছে নিয়মিত, পুলিশ তো শুধু গাড়ি নিয়ে আসলে আর গেলে হবেনা, পুলিশ চাইলেই তো কোন বখাটেরা রাস্তায় গুরতে পারেনা, এভাবে পয়েন্টে পয়েন্টে আড্ডাও দিতে পারেনা, পুলিশকে আরও কঠোর হতে হবে বখাটেদের ব্যপারে, নইলে মেয়েরা কিভাবে লেখাপড়ায় মনোযোগি হবে? যদি তাদেরকে রাস্তাঘাটে এভাবে বিরম্বনায় পরতে হয় তাইলে মেয়েরা নিরাপদ কিভাবে? তাদের স্কুল জীবন সুন্দর কোথায়?”।
সরকারি সতিশ চন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজ মাশহুদ চৌধুরী বলেন “ আমাদের ছাত্রীরা নিয়মিত রাস্তাঘাটে ইভটিজিংয়ের শিকার, ভয়ে অনেক ছাত্রী তার বখাটেদের ব্যপারে বিচার দেয়না, হয়তো তারা ভাবে বিচার দিলে পরে তার রাস্তাঘাটে চলাচল আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে, আমরা এবং অভিভাবকরা সব সময়ই চাই রাস্তাঘাটে বাজে ছেলেদের আড্ডা ও বখাটেপনা বন্ধ হোক, পুলিশ যদি আরও একটু এই বিষয়টাতে নজর দেয় তাহলে শহরের এই প্রকট সমস্যাটা থাকেনা”।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার এহসান শাহ বলেন “ আমাদের পোশাকধারী পুলিশ পয়েন্টগুলোতে ডিউটি না করলেও সাদা পোশাকে পুলিশ রয়েছে, আমি ব্যপারটি অবগত হয়েছি, অবশ্যই এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের টহল কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে এবং বখাটেদের ব্যপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে”।