স্টাফ রিপোর্টার:
বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা ইয়ুথনেট, পিওর আর্থ ও ইউনিসেফ-এর যৌথ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষ্যে বিশাল র্যালি, মানববন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার বিকালে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত হয়। ‘কোনও মাত্রাই সিরা নিরাপদ নয়, সিসা দূষণ বন্ধে কাজ করার এখনই সময়’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে “আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ ২০২৫” পালন করা হয়।
এ উপলক্ষ্যে সচেতনতামুলক লিফলেট বিতরণ পরবর্তী র্যালিতে ইয়ুথনেট গেøাবালের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী, সাধারণ মানুষ, বিভিন্ন যুব ও সুশীল সমাজ সংগঠন, স্থানীয় এনজিও এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, নীতিনির্ধারণী মহল, পরিবেশ অধিকারকর্মী, সমাজকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন। র্যালিটি বিকাল ৪টায় সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সামনে থেকে শুরু করে চৌহাট্টা পয়েন্ট পর্যন্ত পদক্ষিন শেষে বিশাল মানববন্ধন করে। এ সময় সবার হাতে ছিল সিসা দূষণ প্রতিরোধমূলক ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড এবং মুখরিত ছিল “সিসা দূষণ বন্ধ হলে, বাড়বে শিশু বুদ্ধি-বলে”-সহ নানান ¯েøাগান। সিসার বিষক্রিয়া প্রতিরোধ করতে সর্বস্তরে সচেতনতা বাড়ানোসহ সরকার ও নীতিনির্ধারণী মহলকে এ বিষয়ে যথাযথ আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ করে কঠোর ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়ার জোরদাবী জানানো হয়। এ সময় বক্তারা বলেন, সিসা দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে প্রতি বছর অক্টোবর মাসে “আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহ” সারাবিশ্বে পালন করা হয়। জাতিসংঘের বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানে চলতি বছর ১৯শে অক্টোবর থেকে ২৫শে অক্টোবর পর্যন্ত সপ্তাহটি পালন করা হয়েছিল। ত্রয়োদশ আন্তর্জাতিক সিসা দূষণ প্রতিরোধ সপ্তাহের ইংরেজি প্রতিপাদ্য হলো No Safe Level: Act Now to End Lead Exposure| এই প্রতিপাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে সিসার উপস্থিতি অনিরাপদ তাই সিসার বিষক্রিয়া প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নেয়ার দাবী জানানো হয়। বক্তারা বলেন, বিশ্বে সর্বোচ্চ সিসা দূষিত দেশের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের মানুষদের রক্তে মাত্রাতিরিক্ত সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশু অর্থাৎ দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুর রক্তে উচ্চ মাত্রার সিসা বিদ্যমান রয়েছে। সিসা বিষ ক্রিয়ার শিকার হলে শিশুদের বুদ্ধি কমে যায়, পড়ালেখায় পিছিয়ে পরে, মনোযোগে সমস্যা হয়, আচরণগত সমস্যা যেমন মেজাজ খিটখিটে, উচ্ছৃঙ্খলতা এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পরার লক্ষণ দেখা যায়।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সিসা দূষণের কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বছরে প্রায় ১,৪০,০০০ মানুষ মারা যাচ্ছেন। গর্ভবতী নারীদের রক্তে সিসার উপস্থিতির কারণে গর্ভপাত, মৃত সন্তান প্রসবসহ নানান ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। বুদ্ধিমত্তা হ্রাস ও হৃদরোগে মৃত্যুর ফলে দেশের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ২৮,৬৩৩ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার, যার কারণে দেশে বছরে ৬ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আমরা দৈনন্দিন ব্যবহার করি এমন অনেক জিনিসপত্রে সিসা মেশানো থাকতে পারে। যেমন: দেয়াল রং, অ্যালুমিনিয়াম ও সিরামিকের বাসনপত্র, মসলা, শিশুদের খেলনা, কসমেটিক্স বা প্রসাধনী, চাষকৃত মাছের খাবারসহ আরও অনেক কিছুতেই সিসা মেশানো হয়। এছাড়া সিসা দূষণের অন্যতম উৎস হলো অনিরাপদে, খোলা জায়গায় সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি ভাঙ্গা ও সিসা গলিয়ে রিসাইক্লিং করা। তখন সিসা পরিবেশে উন্মুক্ত হয়ে মাটি, পানি ও বায়ু’র দূষণ ঘটায়। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ শতাংশ সিসা ব্যাটারি অনিরাপদে রিসাইক্লিং করা হয়।
সকল পর্যায়ের মানুষকে সিসা দূষণ প্রতিরোধ কার্যক্রমে যুক্ত করতে গুরুতা¡রোপ করে ইয়ুথনেট গেøাবাল এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী (ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট এন্ড এভিডিয়েন্স জেনারেশন) নাজমুন নাহিদ বলেন “আমাদের পরিবেশের সকল উপাদান- মাটি, পানি, বায়ু সিসা দ্বারা দূষিত হচ্ছে। সিসা দূষিত মাটি ও পরিবেশ থেকে এবং বিভিন্ন সিসাযুক্ত ভোগ্যপণ্যের মাধ্যমে সিসা আমাদের শরীরে, খাদ্যচক্রে ঢুকে পড়েছে। এই দূষণ বন্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টি, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ভোক্তা পণ্যে সিসার মান নির্ধারণ করা, অবৈধ সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারি রিসাইক্লিং কারখানা প্রতিরোধ এবং কঠোর মনিটরিং ও আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই।”
তিনি আরো বলেন “সিসা দূষণ আমাদের শিশুদের জন্য খুবই ক্ষতিকর কিন্তু তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। প্রতিটি শিশুরই আছে নিরাপদ, দূষণমুক্ত এবং সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার অধিকার। যুব সমাজের মাধ্যমে সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং দূষণ রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব যা আমাদের শিশুদের জন্য সুস্বাস্থ্য ও সিসামুক্ত নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।”
ইয়ুথনেট সিলেট জেলার সমন্বয়ক নাজির আহমদ সিসা দূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহবান জানান। উক্ত কর্মসূচিতে উপস্থিত অতিথিরা সকলকে সিসা দূষণ প্রতিরোধে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান। র্যালি, মানববন্ধন ও আলোচনা শেষে অংশগ্রহণকারীরা সরকার, নীতিনির্ধারক, দাতা সংস্থাসহ সকলের দাবী জানায়: ১। সিসাকে “বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য”-এর তালিকাভুক্ত করতে হবে এবং জাতীয় পর্যায় থেকে মানবদেহের জন্য সিসার ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে সিসাকে Hazardous Substance হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে।
২। দেশের সকল জনগণের রক্তে কী পরিমাণ সিসার মাত্রা রয়েছে তা পরীক্ষা করতে জাতীয় পর্যায়ে জরিপের উদ্যোগ নিতে হবে, এক্ষেত্রে বিশেষভাবে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া এবং রক্তে সিসার মাত্রা কমাতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৩। ভোগ্যপণ্য ও নিত্য ব্যবহার্য পণ্য যেমন অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র,দেয়াল রং, শিশুদের খেলনা, খাদ্যদ্রব্যসহ ইত্যাদিতে ক্ষতির কারন।